জ্যাঠাজি

-কাজী মোঃ হাসান

পাঁচ-সাত দিনের মধ্যেই রঞ্জু তার আগের ফর্ম ফিরে পেলো। সকালে মক্তব, রাতে দাদুর পড়া, বিকেলে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা এবং খেলাধুলা সহ সবকিছুই চললো সমান তালে। দ্রুত রোগ মুক্তির কারণে বাড়ির সবাই ভীষণ খুশী। এদিকে জ্যাঠাজি নদী থেকে গোসল করে এসেই রঞ্জুর উদ্দেশ্যে ডাকাডাকি শুরু করে দিলেন-
: কই রে আমার খোকা বাবু! এদিকে আয় তো!
ডাক শুনে- জে আজ্ঞে! বলে জ্যাঠাজির কাছে ছুটে গেলো রঞ্জু। তাকে কাছে পেয়ে দুই কাঁধ ধরে ঝাকুনি দিয়ে শরীরের বলটা পরীক্ষা করলেন তিনি-
: বাহ্! আমাদের খোকা বাবু তো একদম ফিট। হ্যাঁ রে, নাস্তা খেয়েছিস?
: খেয়েছি। মুখটা নীচু করে মাথা নেড়েই উত্তর দিলো সে।
: তাহলে এক্ষুনি জামাটা পরে আয়। তোকে নিয়ে আজ এক মজার জায়গায় যাবো।
: কোথায় যাবেন? উৎফুল্ল রঞ্জু জ্যাঠাজিকে জড়িয়ে ধরে জানতে চাইলো বিস্তারিত। কিন্তু জ্যাঠাজি চুপচাপ-
: এখন বলবো না! গেলেই দেখতে পাবি সব। ভীষণ মজা লাগবে! জ্যাঠাজির কথায় রঞ্জুর আগ্রহ আরও বাড়ে।
দৌড়ে ঘরে গিয়ে ফটাফট জামা কাপড় পড়ে ফিট বাবু সেজে খুশীতে আটখানা। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে। তার এই সাজগোজ এবং তাড়াহুড়ো দেখে দাদীমা জিজ্ঞেস করলেন-
: কোথায় যাচ্ছিস রে রঞ্জু?
: বলতে পারবো না! জ্যাঠাজির সঙ্গে যাচ্ছি।
জ্যাঠাজির কথা শুনে দাদী আর কিছু জানতে চাইলেন না। শুধু সাবধান করলেন-
: দেখিস, কোন দুষ্টুমি করিস না যেন!
রঞ্জু নাচতে নাচতে জ্যাঠাজির পাশে এসে দাঁড়ালো। ইতিমধ্যে তিনিও তৈরী হয়ে নিলেন। রঞ্জুর হাত ধরে জিজ্ঞেস করলেন-
: কিরে, হাটতে পারবি তো! অনেক দূর পথ যেতে হবে কিন্তু!
: হ্যাঁ, খুব পারবো! ইয়া লম্বা জ্যাঠাজির উচু মুখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করলো সে। তা সত্ত্বেও জ্যাঠাজি তাকে না হাটিয়ে কাঁধে তুুলে রওনা হয়ে গেলেন সরকার বাড়ির উদ্দেশ্যে ।

রঞ্জুর আব্বুরা চার ভাই। একান্নভুক্ত পরিবার। জ্যাঠাজি বৃটিশ আমলে সৈন্য বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা না কোথায় যেন আহত হয়েছিলেন সামান্য। খবর পেয়ে বাড়িশুদ্ধো লোকের সে-কী কান্নাকাটি! জেঠিমার চোখ আর নাকের পানি এক হয়ে সারাদিন ঝরছে তো ঝরছেই, যতদিন না জ্যাঠাজি বাড়ি ফিরে আসেন। ছেলেকে কাছে পেয়ে দাদী ভীষণ খুশী। তিনি জেদ ধরলেন-
: অনেক হয়েছে, আর না! এবার চাকুরীটা ছেড়ে দে।
জ্যাঠাজি হাসতে হাসতে অনেক বুঝালেন-
: চাকুরী ছাড়বো কেন? আর, চাকুরী ছেড়ে দেশে এসে করবোটা কি?
: কী করবি না করবি সে পরে দেখা যাবে! এখন চাকুরিটা তো ছাড়!
এই নিয়ে মা-ছেলের রশি টানাটানি করতে করতে বৃটিশ আমল শেষ। তখনও জ্যাঠাজি চাকুরীতে বহাল তবিয়তে। কিন্তু কাষ্মীর যুদ্ধে তিনি পুনরায় আহত হলেন।
এবার দাদীর দলটা ভারী হয়ে গেলো। দাদুও যোগ দিলেন দাদীর সঙ্গে। দু’জনেরই এক কথা-
: চাকুরীটা ছেড়ে দে।
বললেই কি চাকুরী ছাড়া যায়? বিশেষ করে সৈনিকদের চাকুরী? শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে চাকুরীটা ছাড়তে সক্ষম হলেন তিনি।
চাকুরী ছাড়লে কী হবে- সৈনিক জীবনের ‘কমান্ডার’ পদবীটা তাকে ছাড়লো না কিছুতেই। বরং আরো ঝেকে বসলো তাঁর জীবনে।
এখন ছোট-বড় সব্বাই তাঁকে কমান্ডার বলে ডাকে। আস্তে আস্তে জ্যাঠাজির আসল নামটাই বিলুপ্ত প্রায়। প্রথম প্রথম জ্যাঠাজি বাধা দিলেও এখন আর তেমন কিছু বলেন না।

জ্যাঠাজি ছিলেন নিঃসন্তান। তাই তার কাছে রঞ্জু ছিলো হীরার টুকরো। রঞ্জুরও পোয়াবারো! দাদা-দাদীর পরে তার যত আবদার, যত খুনসুড়ি এই জ্যাঠাজির কাছেই। আর তিনিও পারেন বটে! রাশ ভারী লোক হলে কী হবে, বাচ্চাদের সঙ্গে তাঁর রাগটা যেন পানি হয়ে থাকে সব সময়। বিশেষ করে রঞ্জুর বেলায় তো কথাই নেই! তার কোন কষ্টই দেখতে রাজি নন তিনি।
জ্যাঠাজি দেশে এসে কি করবেন না করবেন- এই নিয়ে ভাবতে ভাবতেই কয়েক মাস কাবার। কিন্তু বেকার বসে থাকাও কিন্তু খুব কঠিন। তাই মনপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছেন একটা কিছু করার জন্য। আজ এটা করেন তো কাল অন্যটা। কিছুদিন পর দেখা যায় আগেরগুলো সব বাদ। আবার নতুন কাজে হাত দিতেন তিনি। তবে কোন কাজই যুতসই হচ্ছিল না। যেটাতেই হাত দেন সেটাতেই ঝামেলা, ঠিক মতো বনিবনা হচ্ছে না কোনটাতেই। তাই, বলতে গেলে শুয়ে বসেই পার করছিলেন সময়টা।
হঠাৎ একদিন দক্ষিণ পাড়ার মতি সরকার জ্যাঠাজিকে ধরে বসলেন-
: কমান্ডার! দেখেছো, গ্রামটা কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। আনন্দ-ফুর্তি বলতে কিচ্ছু নেই। তোমার হাতে তো অনেক সময়। চল, নিজেদের কাজের পাশাপাশি গ্রামের জন্য কিছু একটা করি।
: তুমি ঠিকই বলেছো। গ্রামে আসার পর থেকে আজ অবধি খেলাধুলা বা আনন্দ উৎসরের কোন আয়োজনই চোখে পড়েনি। কিন্তু—-। একটু থামলেন জ্যাঠাজি। তারপর জানতে চাইলেন-
: সব তো বুঝলাম। কিন্তু আমরা করবোটা কী, বলতো?
: আমরা অনেক কিছুই করতে পারি। যেমন ধরো- ক্লাব গঠন করে বড়দের জন্য নৈশ স্কুল, ছেলে-মেয়েদের জন্য কর্মসংস্থান মূলক পরিকল্পনা অথবা সবাইকে আনন্দ ফুর্তি দেয়ার জন্য যাত্রা, নাটক এবং খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে পারি।
: এগুলো তো খুব কঠিন কাজ। আমরা পারবো তো?
: আমরা পারবো না তো পারবে কে? মতি সরকার প্রচন্ড ভাবে সাহস দিলেন জ্যাঠাজিকে।

শেষে অনেক চিন্তা ভাবনার পর ঠিক হলো, গ্রামে একটা ক্লাব গঠন করা হবে- যার লক্ষ্য থাকবে গ্রামের উন্নতি এবং সবার মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করা। আরো ঠিক করা হলো, এই ক্লাবের উদ্দ্যোগেই একটা নৈশ স্কুল এবং বিনোদনের জন্য যাত্রা পালা করা হবে, যার নেতৃত্ব দেবেন জ্যাঠাজি।
তবে, গোলমাল বাধলো নেতৃত্ব দিয়ে। দলনেতা হিসেবে থাকতে জ্যাঠাজির ঘোর আপত্তি-
: আমাকে বাদ দাও। তোমরা বরং অন্য একজনকে দায়িত্বে রাখ।
কিন্তু কোন আপত্তিই গ্রাহ্য হলো না। সবার এক কথা-
: তোমাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। তুমি হলে শিক্ষিত মানুষ। বিপদ-আপদ এলে সামাল দিতে পারবে। তাছাড়া আমরা যদি গান-বাজনার দল করি, তোমার চেয়ারম্যান চাচা নির্র্র্ঘাত লাঠি নিয়ে তেড়ে আসবেন। তখন আমরা কী করবো?
: কী যে বলেন মতি ভাই! চেয়ারম্যান চাচা কখনও এমন নন। আজ চল্লিশ বৎসর ধরে তিনি চেয়ারম্যানগিরি করছেন। তিনি তরুণ প্রজন্মের চিন্ত-ভাবনা সব বুঝেন।
: বুঝলেই ভালো। তবু আমরা চাই তুমি আমাদের সঙ্গে থাকো এবং নেতৃত্ব দাও।
: আচ্ছা ভেবে দেখি! কথাটা বলেই সেদিনের মতো বাড়ি ফিরলেন তিনি।
এ নিয়ে আরও কয়েক দফা বৈঠক চলে তাদের মধ্যে। ঠিক হলো, যে যাত্রা পালাটা মঞ্চস্থ করা হবে আর সেটা লিখবেন জ্যাঠাজি নিজে।
হলোও তাই। এক মাস খেটে-খুটে “সাগর ভাসা’ পালাটা লিখে ফেললেন। সেটারই রিহার্সাল হচ্ছে সরকার বাড়ি। আজ রঞ্জুকে নিয়ে সেখানেই গেলেন তিনি।
রিহার্সাল দেখে রঞ্জু তো অবাক! এখানে খুব মজার মজার ঘটনা ঘটছে একটার পর একটা! কি কারণে যেন ছেলেরা মেয়েদের মতো কথা বলছে, অদ্ভুত সব অঙ্গভঙ্গী করে নাচানাচি করে গান গাইছে। এ ছড়া রঞ্জুর বিষ্ময় একটা কাঠের বাক্স নিয়ে। গানের সময় ঐ বাক্সের কালো কালো কটিগুলো উপর টিপ দিলেই ভেতর থেকে অসম্ভব সুন্দর সুর বের হয়ে আসছে। একদম কলের গানের মতো। বিশ্বাসই হতে চায় না, একটা বাক্সের ভেতর থেকে এত মিষ্টি সুর বের হয় কি ভাবে?
আচ্ছা, কী করে এমনটা হয়? রঞ্জু কিছুতেই হিসেবটা মেলাতে পারে না। একবার মনে হয়- বাক্সটার ভেতর একটা কলের গান আছে। আবার মনে হয়- এর ভেতর অনেকগুলো মার্বেল পাথর আছে, যেগুলো একে অপরের সঙ্গে টক্কর খেয়ে এধরণের সুন্দর আওয়াজ তুলছে। রঞ্জু যত ভাবছে ততই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে সবকিছু।
আসল বিষয়টা জানার আগ পর্যন্ত পেটের ভাত হজম হবে না রঞ্জুর। কিন্তু জানবে কী ভাবে? জিজ্ঞেস করবে কাকে? কাউকে জিজ্ঞেস করলে সে যদি রঞ্জুকে বোকা ভেবে হাসাহাসি করে! তখন কি হবে?
সবদিক বিবেচনা করে চুপচাপ বসে থাকতে বাধ্য হলো সে। কিন্তু এভাবে থাকার লোক তো সে নয়।
এক সময় রিহার্সালে বিরতি পড়লো। বিরতি পেয়ে চা-বিস্কুট নিয়ে খেতে বসলো সবাই। রঞ্জুও বাদ গেলো না। সেও পেলো এক কাপ চা এবং দু’টি লাঠি বিস্কুট।
: সাবধান রঞ্জু! চা কিন্তু খুব গরম। জিহ্বা পুড়ে ফেলিস না যেন! জ্যাঠাজি হুঁশিয়ার করে দিতে দিতে রঞ্জুর কাছে এসে আরাম করে বসলেন।
সুযোগ পেয়ে রঞ্জু জ্যাঠাজির আরো কাছে এসে কানে কানে জিজ্ঞাস করলো-
: আচ্ছা জ্যাঠাজি, ঐ কাল বাক্সটার নাম কী?
: কোনটার কথা বলছিস?
: ঐ যে, ঐ বাক্সটা। আঙ্গুল তুলে বাক্সটা দেখালো রঞ্জু। যেটাতে টিপ দিলেই কলের গানের মতো মধুর সুর বের হয়।
জ্যাঠাজি হাসতে হাসতে জবাব দিলেন-
: কোনটার কথা বলছিস? ঐ যে ওটা, না না ওটা বাক্স নয়, ওটার নাম হারমোনিয়াম।
: হারমোনিয়াম! এটা আবার কি? কখনও নামটা শুনেছে বলে তো মনে হয় না। তাই নামটা বার বার উচ্চারণ করে ভালো মতো মুখস্ত করে নিলো যাতে ভুলে না যায়। বন্ধুদের কাছে এই অভিজ্ঞতার কথা বলার সময় যদি নামটা বলতে না পারে তা হলে ইজ্জত নিশ্চিত পাঞ্চার। বলার আনন্দটাই মাটি।
: আচ্ছা জ্যাঠাজি, ওটার ভেতর থেকে এতো সুন্দর আওয়াজ বের হয় কী ভাবে? কী আছে ওটার ভেতর? আমার কিন্তু সব জানতে খুব ইচ্ছে করছে। উত্তরে জ্যাঠাজি কিছু না বলে শুধু মুচকি হাসলেন। তারপর রঞ্জুর মাথা চাপড়ে পুনরায় যোগ দিলেন রিহার্সালে-
: এখন কাজ করি! পরে তোকে সব বুঝিয়ে বলবো, কেমন?
জোহরের আযান পড়তেই রিহার্সাল বন্ধ করে বাড়িতে ফিরে আসে রঞ্জুরা। কিন্তু উত্তেজনায় রঞ্জু দুপুরে ভাল করে খেতেও পারলো না। তার মাথায় একটাই চিন্তুা- কখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে এবং চুটিয়ে বন্ধুদের কাছে ঘটনার বর্ণণা করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে।
কোনমতে নাকে মুখে কিছু দিতে যত দেরি, তারপরই দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে ছুটলো বন্ধুদের উদ্দেশ্যে। তার তাড়াহুড়া দেখে দাদী জিজ্ঞেস করলেন-
: এতো তাড়াহুড়– করে কোথায় যাচ্ছিস?
কিন্তু দাদীর কথাটা কানেই গেলো না। তার আগেই সে উধাও।
সব কথা শুনে রঞ্জুর ভাগ্য নিয়ে ঈর্ষা না করে পারে না বন্ধুরা। সবার এক কথা-
: রাজ কপাল না হলে কি এমন জ্যাঠাজি কেউ পায়? (চলবে——)

(‘রঞ্জুর ছেলেবেলা’ থেকে)

Related posts

Leave a Comment